ফেনী সংবাদদাতা : ভারতীয় পানির চাপে সাম্প্রতিক বন্যায় ফেনী জেনারেল হাসপাতালের নিচতলা তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় জেলা শহরে একের পর এক হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করেও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না বিভিন্ন রোগীর স্বজনরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে শহরের ৭টি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করে চিকিৎসক দিয়ে সরকারি মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে বন্ধ ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ। পাওয়া যায়নি রোগীর খাবার ও প্রয়োজনীয় পথ্য। তবুও জেলার ৩টি সরকারি হাসপাতালে শুধুমাত্র মোমবাতির আলোতেই জন্ম নিল শতাধিক শিশু। যার ৯০ শতাংশই প্রসব হয়েছে স্বাভাবিক ভাবে। যদিও বাথরুম ও পরিচ্ছন্নতার পানিও ছিলোনা হাসপাতালগুলোতে। জেনারেটর রুমে পানি ঢুকে বিকল হয়ে গেছে যন্ত্র। স্বল্প পরিসরে দুজন চিকিৎসক ও দুজন নার্স দিয়ে কোনো রকম প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা মিলছে না জেলার সর্ববৃহৎ এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। একই অবস্থার খবর পাওয়া গেছে বাকি ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠান থেকেও। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিন দেখা যায়, ১ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে হাসপাতালের প্রবেশপথ। ভেতরে ঢুকতেই হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা জানান, বন্যার কারণে গত বুধবার রাতে আকস্মিকভাবে হাসপাতালটির নিচতলা ডুবে যায়।
এ সময় হাসপাতালের আশপাশ পানির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে। এতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও দায়িত্বরত চিকিৎসক-কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালের নিচতলায় থাকা নবজাতক শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, স্টোর রুম, ডায়ালাইসিস ইউনিট, ডেন্টাল ইউনিটের সরঞ্জামে পানি ঢুকেছে। অবস্থা বেগতিক থাকায় জরুরি বিভাগের কার্যক্রম নিচতলা থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ। তারা জানান, জেনারেটর চালু করার কিছুক্ষণ পর ওই কক্ষে পানি ঢুকে সেটিও বিকল হয়ে পড়ে। প্রবল অন্ধকারে সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে ৫দিন ধরে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। নৌকা ও ট্রলার ব্যবহার করে জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গুরুতর রোগী হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও মেলেনি কোনো চিকিৎসাসেবা। সড়ক ও হাসপাতাল এলাকায় ৫-৬ ফুট পানি থাকায় কর্মস্থলে আসতে পারেননি চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা। সরজমিনে আরও দেখা যায়, পানি কমে যাওয়ায় নিচতলায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রোগীদের দ্বিতীয় তলায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন দুজন চিকিৎসক ও দুজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। তখনও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে দুই শতাধিক রোগী। গত দুদিন সড়কে পানি বেশি থাকায় আগত রোগীর সংখ্যা সীমিত ছিল। মঙ্গলবার পানি নেমে যাওয়ার পর জরুরি বিভাগে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়। প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় রোগীদের কোনো মতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শহরের ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী ও স্বজনরা জানান, গত বুধবার থেকে হাসপাতালে আলো জ্বলেনি। বাথরুমে পানি নেই। হাসপাতালে ছিল না কোনো চিকিৎসক। পাওয়া যায়নি সরকারি খাবার ও পথ্য। মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের থেকে পাওয়া শুকনো খাবারে দিন পার করতে হচ্ছে। তবে স্বেচ্ছাসেবকরা মঙ্গলবার শুকনো খাবার, পানি ও মোমবাতি দিয়েছেন রোগীদের।
এমন অবস্থা শুধু ফেনী জেনারেল হাসপাতালেই নয়, একই চিত্র জেলার বাকি ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও।
এই অবস্থার খবর পেয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে এসে গত কয়েকদিন স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন সফিকুল ইসলাম নামে এক যুবক। গত শুক্রবার এ হাসপাতালে আসেন তিনি। দেখেন নতুন বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগী আছে। কিন্তু কোনো চিকিৎসক বা নার্স নেই। পুরাতন ভবনে দুজন করে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সকে দেখেন। জেলার সর্ববৃহৎ হাসপাতালের এমন অবস্থা দেখে সফিকুল এখানে থেকে গেছেন। ও রোগীদের খাবার-পথ্যের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ শুরু করেন।
ফরিদুল ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন জানান, গত রোববার তার সন্তানের ডায়রিয়া শুরু হয়। অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে শহরের আলকেমি হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন হাসপাতালে তালা। সেখানকার নিরাপত্তারক্ষাকর্মীরা তাকে জানান, হাসপাতালে বিদ্যুৎ, পানি, চিকিৎসক-নার্স নেই। তাই এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পরে সন্তানকে দ্রুত রিকশাযোগে পানি পার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে এনে একই অবস্থা দেখেন ফরিদুল। হাসপাতাল থেকে তাকে প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। ২ ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো সেবা না পাওয়ায় একটি ভ্যানে করে ছেলেকে অন্য হাসপাতালে নেন তিনি।
এমন বিড়ম্বনার শিকার ফরিদের মতো আরও কয়েকজনও হয়েছেন। বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও পরিস্থিতি এখনও আগের মতোই রয়েছে গেছে।
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আসিফ ইকবাল বলেন, বন্যায় হাসপাতালটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।এরপরও জেলা প্রশাসনের পরামর্শে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শহরের ৭টি প্রাইভেট হাসপাতালকে ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করে ওইসব হাসপাতালে সরকারি ৩০ চিকিৎসককে রোস্টার দায়িত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে না এলেও ডেডিকেটেড হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন। হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হওয়া রোগীদের সরকারি মূল্যে সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে।বিদ্যুৎ না থাকলেও মোমবাতির আলো দিয়েই বন্যা শুরুর প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত এ ৪৮ জন প্রসূতিকে স্বাভাবিক প্রসব করানো হয়েছে।’
এছাড়া জেলার ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রাস্তার ৫ থেকে ৬ফুট উচ্চতায় পানি উঠে গিয়েছিল। এর পাশে নির্মানাধীন ৬তলা আরেকটি ভবনে বন্যাকবলিত মানুষজন আশ্রয় নিয়েছিলেন।তারপরও বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থার মাঝেও শুধুমাত্র মোমবাতির আলোতেই ২৪ ঘন্টা চালু ছিল জরুরি সেবা।উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.মোহাম্মদ মঈনদ্দীন মোর্শেদ জানান,এর মধ্যেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ১৯ অন্তঃসত্ত্বার স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে।
অন্যদিকে ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.শোয়েব ইমতিয়াজ নিলয় জানান, বন্যা পরিস্থিতির ৭দিনে সেখানেও ৪৪ জন নারী সাধারণ প্রসব করেছে। ৪ জনের সিজার লেগেছে।
ফেনীর সিভিল সার্জন ডা.মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন জানান, আমাদের বেশ কিছু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পানির নিচে ছিল।বিচ্ছিন্ন ছিল বিদ্যুৎ সংযোগ।এরপরও বিকল্প উপায়ে আমারা সেবা দিয়েছি। সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ আসে মঙ্গলবার। তবে থাকছেনা বেশিরভাগ সময়। বুধবার পুরোপুরি জেনারেল হাসপাতাল চত্বর থেকে পানি নামে।
ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন,বিদ্যুৎ না থাকলেও বন্ধ ছিলনা ফেনীর চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। জেলার একটি এবং ৬ উপজেলার ৬টি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করে সেবা চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। বন্যার প্রথম ৫ দিন বিদ্যুৎ ছিল না। তবুও মোমবাতির আলোতে চলছে সেবা কার্যক্রম।
স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদ বলেন, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে চিকিৎসক এনে ফেনীতে থাকা চিকিৎসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ডেডিকেটেড করে জরুরি অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। আমরা দ্রুত ফেনী জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছি। অচিরেই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে।