May 24, 2018
৯ বছর পার হলেও সাতক্ষীরায় আইলার ক্ষত শুকায়নি

দুই অবুঝ সন্তান ও স্ত্রীসহ গোটা পরিবারকে ছিনিয়ে নিয়েছিল আইলা। পৈত্রিক বসতভিটা আর সহায় সম্পদ, কোন কিছুই রেহাই পায়নি আইলা’র ভয়ংকর ছোবল থেকে। তারপর একে একে নয়টি বছর পেরিয়েছে, অদ্যাবধি স্বাভাবিক হয়নি ১০নং সোরা গ্রামের আব্দুল মাজেদের জীবন। গোটা পরিবারকে হারিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে পড়া মাজেদ আজও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। সবাই চলে গেলো, শুধু আমাকে রেখে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা সইবার জন্য-উল্লেখ করে ভাঙনমুখে থাকা বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে মাজেদ জানায়, বেঁচে থাকাটাই এখন একটা যন্ত্রণা’।
তিনি জানান, প্রলয়ংকরী ওই জলোচ্ছ্বাস পরিবারের সবাইকে ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তাকে রেখে গেছে কষ্টের বোঝা বইবার জন্য। আইলার আঘাতের পর প্রায় এক বছর সরকারি বেসরকারি সাহায্য নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এক বছর পর হতে পার্শ্ববর্তী নদী আর বনের উপর ভর করে কোন রকমে জীবিকা চলছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে বনে দস্যুদের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া এবং নদীতে পোনা ধরা বন্ধের ঘোষণায় এখন না খেয়ে মরার যোগাড়।
এমন অবস্থা কেবল আব্দুল মাজেদের ক্ষেত্রে ঘটছে, তা নয়। বরং গোটা উপকূলজুড়ে বসবাসরত প্রতিটি পরিবারকে কমবেশি আজও ভয়ংকর সে আইলার তান্ডবের যন্ত্রণা বহন করতে হচ্ছে। নিরন্তর তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য।
মাজেদের প্রতিবেশি বরকত গাজী আর আমিরুল ইসলামসহ কয়েক জানায়, আইলার পর নয়টি বছর পার হয়েছে। আইলা তাদেরকে বিধ্বস্থ করে যেখানে রেখে গেছিল, সেখান থেকে আজও তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে খাবার উপযোগী পানি এমনকি জ্বালানীর সংকটে পড়ে তারা চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এছাড়া উপকূল রক্ষা বাঁধসমুহ অদ্যাবধি স্থায়ীভাবে মেরামত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত পরিবার পরিজন নিয়ে চরম আতংকে কাটাচ্ছে বলেও দাবি তাদের।
নাপিতখালী গ্রামের আজিজুল গাজী বলেন, আইলার সময় সাগরের লবন পানি এসে সমগ্র এলাকা ভাসিয়ে দেয়। এরপর থেকে সেখানে কৃষি ফসল উৎপন্ন হয় না, গাছ-গাছালী শুণ্য হয়ে পড়া গোটা এলাকা মরুভুমির মত পড়ে আছে। কাজের খোঁজে মানুষ প্রতিদিন প্রায় দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে বলেও দাবি তার।
আইলার ক্ষত শুকাতে আরও অনেক দিন লাগবে-উল্লেখ করে নাপিতখালী জামে মসজিদের ইমাম মহসীন আলম জানায়, তার ভাই মাসুম বিল্লাহ গত নয় বছর পরেও এলাকায় ফেরেনি। পরিবার পরিজন নিয়ে খুলনাতে কাজকর্ম করে খাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এলাকায় কৃষি ফসল উৎপাদন না হওয়ায় অল্পসংখ্যাক মানুষ জোয়ারের লবন পানি নিয়ে চিংড়ি ঘের পারিচালনা করছে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ কাজের অভাবে উত্তরাঞ্চলে যেয়ে ধান ও মাটি কাটার পাশাপাশি ইটের ভাটায় কাজ করে মৌসুমী শ্রমিক পরিচয়ে কোন রকমে বেঁচে আছে।
এদিকে আইলায় লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় গত নয় বছরের প্রতিটি মুহূর্তে এলাকায় অবস্থানকারীরা চরম আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছে বলে জানান, আমিরুল ইসলাম, মোসলেম গাজীসহ অনেকে।
তারা জানায়, বেড়িবাঁধের যা অবস্থা তাতে গত কয়েক বছর ধরে তারা চরম আতংকে রয়েছে। পাউবো’র পক্ষ থেকে সংস্কারের কোন উদ্যোগ না নেয়ায় ক্ষনে ক্ষনে তাদের উদ্বে আরও বেড়ে যাচ্ছে। আইলার মত নুতন কোন জলোচ্ছ্বাসের আতংকে কাটে তাদের প্রায় প্রতিটি দিন।
কর্মসংস্থান, ভাঙন কবলিত বাঁধ, ব্যবহার উপয়োগী পানি আর জ্বালানী সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় নিপতিত হওয়ার অভিন্ন দাবি শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালীনি, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালীসহ আইলার নির্মমতা শিকার গোটা জনপদের হাজারও মানুষের।
সরেজমিনে এসব এলাকা ঘুরে দেখা মিলেছে মাঝেমধ্যে কোন কোন জায়গায় দুই চারটি তাল কিংবা নারকেল গাছ খাড়া দাঁড়িয়ে থাকলেও অধিকাংশ এলাকা বৃক্ষরাজী শুণ্য। সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা বেশকিছু বসত ঘরের দেখা মিললেও বড় ধরণের ঝড়ো বাতাস কিংবা জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করার মত শক্তি নেই সেসব আশ্রয়স্থলের। আর উপকুল রক্ষা বাঁধের অবস্থা দেখলে মনে হয় আইলার ভয়ংকর স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে।
জেলেখালী গ্রামে পৌছে দেখা যায় বাঁধের উপর বসে আছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব দিদারুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। সংবাদকর্মী পরিচয় দিতেই প্রায় প্রত্যেকে কমবেশি বিরক্তি প্রকাশ করে। শুরুতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা দিদারুল বলেন, নটা বছর হয়ে গেলো, তবু তোমরা আমাগো বাঁধটা বানদি (বেঁধে) দিতি পাল্লে (পারলে) না। শুধু আইলার সময় আসলি আসো আমাগো ভাল মন্দ জানতি, পেপারে লেখার জন্যি।
পরক্ষণে কিছুটা নরম স্বরে তিনি আরও বলেন, বাবা! তোমরা কষ্ট নিও না, অনেক আফসোস থেকে এসব কথা বলতি বাধ্য হইছি। তোমরা এবারও আইছো যখন ঘুরে ঘুরে দেকি যাও ভাঙনধরা বাঁধ কিভাবে আমাগো অস্থির করে রেখেছে।
পাশে বসা জাহিদুল ইসলাম জানায়, আইলার পর থেকে লবণাক্ততার কারণে গোটা এলাকায় কৃষি ফসল উৎপাদন না হওয়ায় স্থানীয়রা পাশের নদী এবং সুন্দরবনকে আশ্রয় করে বাঁচার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সুন্দরবনে ডাকাতের তৎপরতার পাশাপাশি নদীতে নেমে রেণু পোনা ধরা বন্ধে পুলিশি হয়রানীর মধ্যে এখন তারা নিদারুণ অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েছে।
নয় বছরেও দুর্যোগ কবলিত উপকূলবাসীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত না হওয়ায় ক্ষোভ জানায়, চাঁদনীমুখা গ্রামের আলাউদ্দীন ও ফজের আলীসহ অন্যরা। তাদের অভিযোগ বন-বাদা ও নদীতে নামা বন্ধ হওয়ার পর এখন এলাকাবাসির না খেয়ে মরার উপক্রম হয়েছে। তারা আরও বলেন, আইলার আগে গাবুরা এলাকায় প্রায় ১৪ কি. মি. ইটের সোলিং থাকলেও গত নয় বছরে প্রায় শত কি. মি. রাস্তার কোথাও একটি ইট পড়েনি।
সরেজমিনে ঘুরে এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আইলার পর একে একে নয়টি বছর পার হয়েছে। কিন্তু আইলার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ক্ষতির শিকার জনগোষ্ঠীর কেউই আজ পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে ক্ষতি। পুরোপুরিভাবে বিধ্বস্থ জনপদে পরিণত হওয়া ঐসব এলাকা আজও মরুভূমির রুপ নিয়ে আছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এলাকার বাইরে যেয়ে কাজকর্ম করে কোন রকমে সংসারের খরচ যোগানোর চেষ্টা করলেও ভাঙনমুখে থাকা বিস্তীর্ণ উপকুল রক্ষা বাঁধ নিয়ে প্রতি মুহূর্তে তাদের শংকায় থাকতে হয়। এছাড়া বৃক্ষরাজী শুণ্য জনপদে পরিণত হওয়ায় জ্বালানীর সংকট ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে সেখানে। খাবার পানি থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানের তীব্র সংকটের মধ্যে থাকা সমুদয় এলাকা মানুষ বসবাসের উপযোগী নেই বলে দাবি অনেক ভুক্তোভোগীর।
২৭ কি. মি. উপকুল রক্ষা বাঁধসহ গোটা ইউনিয়নের সমুদয় রাস্তা কাঁচা এবং জীর্নশীর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন গাবুরার চেয়ারম্যান মাসুদুল আলমের দাবি। তিনি জানান, আইলার পর নয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এলাকার লবণাক্ততা কাটেনি। বৃক্ষরাজী শুণ্য মরুভূমিতে পরিণত হওয়া ওই জনপদে সেভাবে বনায়নের উদ্যোগও নেয়া হয়নি। তার উপর খাবার পানি আর জ্বালানী সংকটে পড়ে গোটা উকূলীয় জনপদের হাজারও পরিবার চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তবে ভয়ংকর অবস্থায় থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধ নিয়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার জনগোষ্ঠীর ওই জনপদ প্রচন্ড ঝুঁকির মধ্যে থাকার কথা জানান তিনি।
সরকারি নির্দেশে নদীতে পোনা ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাাশি বনে ডাকাতের উপদ্রুবে এলাকার হাজারও মানুষ কাজের সন্ধানে বাইরে চলে যাচ্ছে। চতুর্দিকে নদী বেষ্টিত ওই দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরও জানায় পরিবেশ বসবাসের উপযোগী না হওয়ায় আইলার সময় এলাকা ছেড়ে যাওয়া হাজারও পরিবার দীর্ঘ নয় বছরেও এলাকায় ফেরেনি।
সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার দেয়া তথ্যে জানা যায়, আইলার পর বসত ঘর নির্মাণের জন্য পরিবার পিছু বিশ হাজার করে নগদ টাকা দেয়ার পর থেকে সব ধরণের সাহায্য সহযোগীতা বন্ধ রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে উপকুল রক্ষা বাঁধের সামান্য সংস্কার কাজ করা হলেও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে প্রায় শতাধিক কি. মি. উপকূল রক্ষা বাঁধের কোথাও এক ইঞ্চি পরিমান কাজ করা হয়নি। বরং আইলা পরবর্তীতে তাৎক্ষণিকভাবে ভাঙনরোধে শুরু হওয়া সংস্কার কাজ অব্যাহত না থাকায় গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি আইলার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরও অনেক সময় লাগবে। কিন্তু এরমধ্যে আবারও আইলার মত ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলে গোটা উপকূলীয় জনপদে ব্যাপক প্রাণহানীসহ সমুদয় এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ার শংকা জেগেছে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের এই দিনে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট ভয়ংকর ‘আইলা’ আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে। দিনের আলোয় এক মুহূর্তেই সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার উপকূলবর্তী আশাশুনি, কয়রা ও দাকোপ উপজেলার মত সমুদ্রের কোলে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা শ্যামনগর লন্ডভন্ড হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকা কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ভুতুড়ে জনপদে পরিণত হয় গোটা উপকূলবর্তী জনপদ।
স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪/১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নারী ও শিশুসহ কয়েক শত মানুষ, হাজার হাজার গবাদী পশু আর ঘরবাড়ি। ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয় কয়েক লাখ মানুষ। লক্ষ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি, ফসলের ক্ষেত আর শতশত কি. মি. রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে একাকার হয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকুল রক্ষা বাঁধ আর অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আইলা’র তান্ডবে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হওয়া দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদ সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকার ৫ লাখ ৯৫ হাজার ১২২ জন মানুষ মুহূর্তেই নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে। শুধু শ্যামনগরেই গৃহহীন হয় ২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৩ জন। এছাড়া শ্যামনগরের ৯৬ হাজার ৯১৬টিসহ মোট ১ লাখ বিয়াল্লিশ হাজার ২৪৪টি বসতঘর বিধ্বস্থ হয়। উপজেলার ৪৮ হাজার ৪৬০ পরিবারসহ মোট ১ লাখ ১৪ হাজার পরিবার আইলা’র আঘাতে সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
আইলা’র ধ্বংসযজ্ঞে উপজেলার ৩৯৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ৩ শতাধিক মসজিদ, মন্দির স¤পূর্ণ ও আংশিকভাবে ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি ১৭৯ কি. মি. রাস্তা সম্পুর্ণ ও ৯৯ কি. মি. আংশিক নষ্ট হয়ে যায়। ৪১টি ব্রীজ ও কালভাটসহ ১১৭ কি. মি. বেড়িবাঁধ স¤পূর্ণ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। শুধু শ্যামনগরেই ১২৭ কি. মি. বাঁধের ৯৭ কি. মি. স¤পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

More News


সম্পাদক র্কতৃক প্রকাশিত

e-mail: alorparosh@gmail.com- --