October 31, 2019
রাজধানীতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৫ শিশুর মৃত্যু ॥ আহত ১৫

আলোর পরশ নিউজ: ‘কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। কারও চেহারা ঝলছে গেছে। ছোপ ছোপ কালচে তাজা রক্ত রাস্তায় গড়াচ্ছে। আনুমানিক ৬-১৪ বছর বয়সী ১০-১২ জন ক্ষুদে শিশু মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। উফ! বীভৎস ও মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখে বুক আঁতকে ওঠে।’
জরুরি সেবা ৯৯৯ ও পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোন পেয়েই ঢাকা মহানগর অ্যামুলেন্স অ্যাসোসিয়েশনের যে কর্মকর্তা রূপনগরে ছুটে গিয়েছিলেন, সেই প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তা ঠিক এভাবেই গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে ঘটনাস্থলের বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
এই বর্ণনাতীত ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায়। ওই ঘটনাটি গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের। এতে ৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে আরও অন্তত ১৫ জন। গতকাল বুধবার বিকালে মনিপুর স্কুলের রূপনগর শাখার বিপরীত দিকে ১১ নম্বর সড়কে এ ঘটনা ঘটে বলে রূপনগর থানার পরিদর্শক অপারেশন মোকাম্মেল হক জানান। তিনি বলেন, “এক বেলুন বিক্রেতার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে চারজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ভ্যানে করে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করছিল এক বিক্রেতা। “পাশেই বস্তি এলাকা হওয়ায় অনেকেই ভ্যান ঘিরে এবং আশপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউবা বেলুন কিনছিল। এসময় হঠাৎ করে বিস্ফোরণ ঘটে।”
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে জানিয়ে জ্যেষ্ঠ স্টেশন অফিসার আনোয়ার হোসেন তাৎক্ষণিকভাবে বলেন, “নিহতদের মধ্যে চারজন শিশু; আরেকজন আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী এক নারী। তার পরিচয় জানা যায়নি।”
নিহত চার শিশু হল- রমজান (৮), নুপুর (১০), শাহিন (৭) ও জান্নাত (১৪)। তবে তাদের বিস্তারিত পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি পুলিশ।
ঘটনাস্থল থেকে মোট ১৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে মেডিকেল ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, “তাদের মধ্যে চারজন প্রাপ্তবয়স্ক, বাকি সবাই শিশু। আহতদের মধ্যে দুজনের অবস্থা ভালো নয় বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।”
আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া জানান, এক নারী ও তিন শিশুসহ চারজনকে মৃত অবস্থায় এই হাসপাতালে আনা হয়। আহতদের মধ্যে চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিস্ফোরণে নিহতদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়। এ চারজনের দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। যে দুজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তারা বিপদমুক্ত।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়াতে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন।
রূপনগরের ঘটনায় আহত হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন এক মেয়ে শিশুর কাছে গণমাধ্যমকর্মীরা বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তার চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। ফ্যালফ্যাল করে এদিক সেদিক তাকায়। তারপর জানায়, বেলুন কিনতে সেখানে গেলেও একটু দূরে ছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনে এবং বেশ কয়েকজন সমবয়সীর চিৎকার শুনতে পাই। তার পায়ের আঙুলে ভীষণ ব্যথা করছে বলে সে কান্নাজুড়ে দেয়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিহত এক শিশুর খালা জানান, তার বোনের মেয়ে বাবার কাছে বেলুন কেনার বায়না ধরলে তার বাবা তাকে টাকা দিয়ে বেলুন কিনতে পাঠান। কিছুক্ষণ পরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে এসে মেয়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী নিহতদের নাম জান্নাত, নূপুর, শাহিন ও রমজান বলে দাবি করেন।
তারা জানান, রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সড়কে দুই-তিন দিন পরপরই গ্যাস বেলুন বিক্রি করতে আসতেন এক ব্যক্তি। আসা মাত্রই তাঁকে ঘিরে ধরত ফজর মাতবরের বস্তির শিশুরা। বরাবরের মতো গতকালও বেলুন বিক্রেতার গাড়িটিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল শিশুরা। সেটিই কাল হলো তাদের। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মুহূর্তেই ঝরে গেছে তাজা প্রাণগুলো। নিহত পাঁচ শিশু হলো: শাহিন (১০), নূপুর (৭), ফারজানা (৯), জান্নাত (১৪) ও রমজান (৮)। রূপনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সুমন নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একটি ভ্যানগাড়িতে করে ওই ব্যক্তি মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গ্যাস বেলুন বিক্রি করতেন। গতকাল বিকেলে রূপনগর ১১ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় ফজর মাতবরের বস্তির সামনে বেলুন বিক্রি করতে আসেন তিনি। তাঁকে দেখামাত্রই বস্তির শিশুরা তাঁকে ঘিরে ধরে। এ সময় সিলিন্ডারে পাউডার জাতীয় কিছু একটা ভরছিলেন ওই বেলুন বিক্রেতা। এর পরপরই হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে থাকা ১০-১২ জন প্রায় ১৫ ফুটের মতো ছিটকে পড়েন। বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থলে চার শিশুর ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায়। পেটে আঘাত পাওয়া আরেক শিশু দৌড়ে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরই সে লুটিয়ে পড়ে। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. হোসেন বলেন, ‘বিস্ফোরণের স্থান থেকে কিছুটা দূরে আমি ঝালমুড়ি বিক্রি করি। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ওই বেলুন বিক্রেতা ভ্যান নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আমি তাঁকে চলে যেতে বলি। এরপর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে তিনি একটি টিনশেডের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ পর বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই।’ বিস্ফোরণে বিকট শব্দ হলেও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসীরা।
বিস্ফোরণে আহত নারী জান্নাত বেগমের স্বামী নজরুল ইসলাম বলেন, বিকেলে বাজার করে ফেরার সময় ১১ নম্বরের সড়কের মাথায় আসতেই বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে তাঁর স্ত্রীর ডান হাতের একটি অংশ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহতদের বেশিরভাগই পথচারী। প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের স্বজনরা বলছেন, তারা বিকট একটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। এরপরেই কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। ঘটনার সময় বেলুনওয়ালা ভ্যানের কাছ থেকে ছিটকে প্রায় ২০ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পাশের টিনশেড ঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাশিদা বেগম দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই পিঠা বিক্রি করছিলেন। তিনিও ফজর মাদবরের বস্তিতে থাকেন। রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমি ঘরে আসছি, এরমধ্যে ঠাস করে শব্দ। সব ধোঁয়া হয়ে যায়। আমার ছেলে আমাকে ডাকতে থাকে। আমি অন্ধকারে বের হতে পারছিলাম না। এরপর আমি নেমে দেখি রাস্তায় বাচ্চাদের লাশ পড়ে আছে। কেউ আহত হয়ে পড়ে আছে। আমার ভাগ্নে বউ জান্নাত পড়ে আছে, সে ধড়ফড় করতেছে। তার হাত ছিঁড়ে গেছে। আমি গিয়ে ধরলাম। এরপর আরও লোক আসে।’
প্রত্যক্ষদর্শী মোস্তফা বলেন, ‘এই বেলুন বিক্রেতা মাঝে মাঝে আসে। ভ্যানে করে বেলুন নিয়ে আসে। ছোট্ট সিলিন্ডার ছিল। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়ে কালো রঙের ছাইয়ের মতো ধোঁয়া হয়ে যায়। এসে দেখি শিশুদের লাশ পড়ে আছে। সড়কে সিলিন্ডারের ভাঙা অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শিশুদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। চুল পুড়ে গেছে। শরীর ঝলসে গেছে। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে। পুলিশ আসার পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসে। এরপর লাশ গাড়িতে তোলা হয়।’তিনি আরও বলেন, ‘সিলিন্ডারের এত শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়েছে, কাছে যারা ছিল, তারা প্রায় দুই তিন মিনিট কানে কিছু শোনেননি।’নিহত শিশুদের বেশিরভাগই ফজর আলী মাদবর বস্তির বলে জানান তিনি।
মিন্টু নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এরপর কালো ধোঁয়া। আমি এসে দেখি লাশ। সবাইকে ধরতে বললাম, ১৩ জনকে আমি সুরক্ষা হাসপাতালে নিয়ে যাই। এছাড়াও আরও আহত ছিল। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘এক নারীর হাত ছিন্ন দেখছি। ওই নারীর নাম জান্নাত। তিনি বাজারে যাচ্ছিলেন। অনেক শিশুর নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। সিলিন্ডারের বিস্ফোরিত অংশ, টিন, ইটভাঙা শিশুদের শরীরে গেঁথে ছিল।’
আহত জান্নাতের দেবর মনির হোসেন জানান, ‘ভাবি (জান্নাত) বাসাবাড়িতে কাজ করেন। মাদবরের বস্তিতে থাকেন। কাজ থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি।’
আরেক আহত শিশু সিয়ামের মামা আরিফ জানান, সিয়ামের বাবা তোফাজ্জল কাঁচামাল বিক্রেতা। ঘটনাস্থলের পাশে রাস্তায় বসে সবজি বিক্রি করেন। পাশের বস্তিতে তাদের বাসা। সিয়াম স্থানীয় স্কুলের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে তার বাবার দোকানে গিয়েছিল। সেখানে সে আহত হয়।
আহত এক রিকশাচালক জুয়েলের স্ত্রী রূপা দাবি করেছেন, তার স্বামী ওই সময় রিকশা নিয়ে সেখান দিয়ে যাওয়ার পথে আহত হন। বিস্ফোরণের শব্দে জুয়েল পড়ে যান বলে জানান তিনি।

More News


সম্পাদক র্কতৃক প্রকাশিত

e-mail: alorparosh@gmail.com- --