August 24, 2019
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশংকা

২৪ ঘন্টায় প্রাণ গেল আরও ৪ জনের
ইবরাহীম খলিল : সরকারি হিসাবে হাজারের ঘর থেকে নামছে না প্রতিদিন নতুন করে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। গতকাল শুক্রবারও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৪৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫৯৭ জন। ২১ আগস্ট ছিল এক হাজার ৬২৬ জন। সরকারি হিসাব মতে কিছুটা কমলেও কোনভাবেই ১ হাজারের নিচে নামছে না। এভাবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চললে এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া সম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনটাই পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সারাদেশে রোগীর সংখ্যা দাড়িয়েছে ৬১ হাজার ৩৮ জনে।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি মঙ্গলবার থেকে ২৩ আগস্ট শুক্রবার পর্যন্ত ৬০ হাজারের বেশি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা- এই সংখ্যা অনেক বেশি, যা সরকারি হিসাবে আসেনি। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রথম হাজারের ঘরে প্রবেশ করে ২৯ জুলাই। এদিন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৯ জন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তা হাজারের ঘরেই আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়- চলতি আগস্টের ৭ দিন ও সেপ্টেম্বরের ৩০ দিন, মোট ৩৭ দিনের প্রতিদিন যদি ১ হাজার ডেঙ্গুরোগী নতুন করে আক্রান্ত হন, তাহলে ওই সময়ে সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৭ হাজারে। অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৫৩ হাজার ১৮২। এ হিসাবে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরাধীন হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানায়, সর্বশেষ ২৩ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ দেশজুড়ে ১ হাজার ৪৪৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগরীতে ৬৮৯ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৭৫৭ জন ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৬১ হাজার ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সী অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। বর্তমানে রাজধানীসহ সারা দেশে হাসপাতালে মোট ৬ হাজার ৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজধানীতে তিন হাজার ৪১১ জন এবং ঢাকার বাইরের দুই হাজার ৬২৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫৪ হাজার ৯৫৬ জন। এর মধ্যে রাজধানীতে ৩২ হাজার ৯৭৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ২১ হাজার ৯৭৭ জন। সরকারি তথ্য অনুসারে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৪৭ বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা দেড়শ’র কাছাকাছি। প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আজও ঢাকায় তিনজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভাষ্য মতে, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুতে ৮০ জনের সম্ভাব্য মৃত্যুর তথ্য এসেছে। তবে তারা বলেছেন, পর্যালোচনা করে এ পর্যন্ত ৪৭ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন।
এখনও পর্যালোচনা চলমান রয়েছে। সব পর্যালোচনার পর দেশে ডেঙ্গুতে এবছর কত লোক মারা গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৩৮ জন। এর মধ্যে চলতি আগস্ট মাসের ২৩ দিনেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৫৭৭ জন। গত জুলাই মাসে ১৬ হাজার ২৫৩ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার সারাদিনে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেলো চার জনের। তাদের একজন গৃহবধূ জাহানারা বেগম (৩৫) ও অপর দু’জন তরুণ ফিজিওথেরাপিস্ট লিটন মালো (২৫) এবং মাদরাসা ছাত্র আলমগীর গাজী (১৪) এবং শিশু আরিয়ান।
জানা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরিয়ান নামে আটবছর বয়েসী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল হাকিম জানান, ডেঙ্গু নিয়ে গতকাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো আরিয়ান। আজ বিকেল সাড়ে তিনটায় তার মৃত্যু হয়।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. আবু শাহীন সাংবাদিকদের জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ই আগস্ট সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি হন জাহানারা বেগম। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। এসময় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। খুলনা নেয়ার পথে মধ্যরাতে ডুমুরিয়া এলাকায় তার মৃত্যু হয়। গৃহবধূ জাহনারা বেগম সাতক্ষীরা সদরের ছয়ঘরিয়া গ্রামের খলিলুর রহমানের স্ত্রী।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার শ্রীকলা গ্রামের সিরাজুল গাজীর ছেলে আলমগীর গাজী (১৪)। মাদরাসা ছাত্র আলমগীর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।
এদিকে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে লিটন মালো (২৫) নামে এক তরুণ ফিজিওথেরাপিস্টের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
ঈদের আগে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন লিটন। তাৎক্ষণিকভাবে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ঈদের তিন দিন আগে সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে যান লিটন। কিন্তু বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে আবারও অসুস্থ হয়ে যান। এসময় বাড়ি থেকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লিটনের প্লাজমা লিকেজ হচ্ছিল, বাইরে থেকে তা বোঝা যাচ্ছিল না। ডেঙ্গুজ্বরের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তারা। লিটন মালো গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ফকির চান মালোর পুত্র। তিনি মিরপুরের সিআরপিতে ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এদিকে ঢাকাসহ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি ভর্তি হয়েছে এমন হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে। মিটফোর্ড হাসাপাতালের ২ নম্বর ভবনের ৫ম তলায় গত ১ আগস্ট ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ ‘ডেঙ্গু ওয়ার্ড’ স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ১১০ জন রোগীর জন্য সিট বরাদ্দ রয়েছে। তবে বর্তমানে হাসপাতালে চার শতাধিক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ রকম চাপ থাকায় বাধ্য হয়ে ডেঙ্গু রোগীদের অন্যান্য বিভাগে পাঠানো হচ্ছে।
ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ইনচার্জ ইসমাত জাহান জানান, এই ওয়ার্ডে কোনো সময়ের জন্য সিট খালি থাকে না। যদি কেউ চলে যান তাহলে সাথে সাথে অন্য কোনো বিভাগ থেকে ডেঙ্গু রোগী এনে এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তদের পাশাপাশি অন্যান্য রোগীর জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিনিয়ত আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা করে যাচ্ছি। কয়েকদিন আগে এই ওয়ার্ডের নার্স লিপি আক্তার ও সারমিন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। বর্তমানে তারা হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যারা ডেঙ্গু রোগীর সাথে এসেছেন তারাও রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। এখানে কেউই নিরাপদে নেই।’
মিটফোর্ড ৩ নম্বর ভবনের নিচতলার পুরুষ ইউনিটে মোট ১০৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী। ওই ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স কবিতা বিশ্বাস জানান, এখানে ১০৪ জন রোগীর জন্য মাত্র চারজন নার্স রয়েছেন। এদের মধ্যে দুপুরে দুজন আর রাতে দুজন থাকে। অন্যান্য বিভাগেও ২০০/২৫০ জন রোগীর জন্য মাত্র কয়েকজন নার্স নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকি। ডেঙ্গু রোগে কখন যে আক্রান্ত হব, তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। হাসাপাতালে যারা আছেন- দর্শনার্থী থেকে শুরু করে কেউ নিরাপদ নয়। মিটফোর্ড হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে ও স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছেন সিরাজ মিয়া (৫৫)। তিনি বলেন, ‘দুই দিন আগে আমার স্ত্রী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এরপর ছেলেরও ডেঙ্গু ধরা পরে। ভর্তি করার সময় ডেঙ্গু ওয়ার্ডে সুযোগ পাইনি। এজন্য মেডিসিন বিভাগের একটা ওয়ার্ডে তাদের ভর্তি করা হয়। তবে ওই ওয়ার্ডগুলোতে ভালো চিকিৎসা হয় না। তবে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে স্থানান্তরের পর ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে।’

More News


সম্পাদক র্কতৃক প্রকাশিত

e-mail: alorparosh@gmail.com- --